সব সম্পাদকই অপেশাদার

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিবেশ সৃষ্টিতে জাসদের ভূমিকা নিয়ে যখন চারদিকে শোরগোল বেঁধেছে সেই সময় জাসদ নেতা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের মালিকানা ও সম্পাদনা নিয়ে একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। সেই চিত্রটি একজন পেশাদার সাংবাদিকের কাছে খুবই লজ্জার।

তথ্যমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যে দেখা যায় দেশের সংবাদপত্রগুলোতে মাত্র ৭ শতাংশ পেশাদার সাংবাদিকরা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশে ছাপানো সহস্রাধিক দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে ৯৩ শতাংশের মালিকই সম্পাদকের পদ দখল করে রেখেছেন। তারা অপেশাদার। তারা কোনোদিন সাংবাদিকতা করেননি। তারাই সম্পাদক। যেদেশে প্রায় সবাই অপেশাদার সম্পাদক সেদেশের সংবাদপত্রের কাছে দেশ ও জাতির মঙ্গল আশা করা যায় কীভাবে। সাংবাদিকরা যে জাতির বিবেক বলে পরিচয় পেয়েছিল সেটা তো হারিয়েছে বহুকাল আগেই। এখনতো দেখা যাচ্ছে আসল পরিচয় নিয়েই টানাটানি শুরু হবে।

সংসদে উত্থাপিত প্রশ্নে মঙ্গলবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আরো জানিয়েছেন দেশে বর্তমানে মোট দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১ হাজার ৭৮টি। এরমধ্যে ১ হাজার ৫টিতে প্রকাশক ও সম্পাদক একই ব্যক্তি। তিনি বলেছেন অধিকাংশ পত্রিকার প্রকাশক বা মালিকই সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। স্বল্প সংখ্যক পত্রিকার প্রকাশক পেশাদার সম্পাদক নিয়োগ করে থাকেন। এটা তথ্যমন্ত্রী না বললেও আমরা জানি অর্থবিত্তের জোরে ব্যবসায়ীরা পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং নিজেরাই সম্পাদকের পদটি দখল করে নেন। কিন্তু সংখ্যাটা যে এতো অধিক সেটা ধারণা ছিল না।

এই সম্পাদকদের কেউ কখনোই সাংবাদিকতা করেননি। তাদের অনেকেই আবার দেশের সংবাদপত্রের মালিকদের বড় সংগঠন ‘নোয়াব’ এর সদস্য। আবার একই সাথে কয়েকজন সম্পাদকদের প্রতিষ্ঠান সম্পাদক পরিষদেরও সদস্য। ২০০৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের তখনকার মালিক মঈনুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএসপি (বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ) ভেঙে কয়েকজন মালিক মিলে ‘নোয়াব’ গঠন করেন। আর ২০১৩ সালে তাদেরই কয়েকজন মিলে সম্পাদক পরিষদ গঠন করেন।

মালিকদের সংগঠন নোয়াবকে কখনোই পেশাদারিত্ব নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। তারা সাংবাদিকদের বেতন ভাতা নির্ধারণের জন্য ওয়েজবোর্ড গঠনের কমিটির বৈঠকে গিয়ে কীভাবে কম বেতন দেওয়া যায় সেই বিষয়ে বিতর্ক করেন। তারা সরকারের সঙ্গে নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক কমানো নিয়ে দর কষাকষি করেন। কখনোই জাতীয় অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেন না।
পাশাপাশি সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন, সাংবাদিকতার পেশাগত মানোন্নয়ন ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে সম্পাদক পরিষদ নামে একটি সংগঠন করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠার পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল। কিন্তু সংগঠনটি জন্মের পর এখন পর্যন্ত সাংবাদিকতার পেশাগত মানোন্নয়ন ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সময় অসময়ে নিজেদের স্বার্থে যখন আঘাত এসেছে তখনই আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা শুধু বিবৃতি দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিরই দায়িত্ব ছিল সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে আদায় করে নেওয়া যেন কোনো অপেশাদার ব্যক্তি সম্পাদক হতে না পারেন।

তথ্যমন্ত্রী সংসদে আরো একটি তথ্য জানিয়েছেন। সেটি হলো দেশের ১০৭৮টি দৈনিক পত্রিকার মধ্যে বর্তমানে মিডিয়াভুক্ত ৪৩৪টি। কেবল মিডিয়াভুক্ত পত্রিকা কোন প্রেস হতে প্রতিদিন কত সংখ্যা ছাপানো হয়, তা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকার মনিটরিং করে থাকে। পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে ছাপাখানার নাম মুদ্রিত থাকে। মিডিয়া তালিকাভুক্ত সংবাদপত্রের ছাপা সংখ্যার ভিত্তিতে ঢাকা মহানগরীতে তালিকাভুক্ত ১২৪টি দৈনিক পত্রিকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত ২৬০টি দৈনিক পত্রিকার প্রচার সংখ্যার তথ্যও তুলে ধরেন মন্ত্রী।

আমরা দেখেছি সংসদে মাঝে মাঝেই সংসদ সদস্যদের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তথ্যমন্ত্রীকে। প্রচার সংখ্যা নিয়েও দেশের তথাকথিত সম্পাদকরা জালিয়াতি করেন। যে পত্রিকা ৫ হাজারও ছাপা হয় না সেটি দেখা যায় এক লাখেরও বেশি ছাপা হচ্ছে বলে প্রকাশনা অধিদপ্তর সার্টিফিকেট দিচ্ছে। আর সেই সার্টিফিকেটে দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন নিচ্ছে। এখানে প্রকাশনা অধিদপ্তর আর সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে লেনদেনের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। কিন্তু কেউ এ নিয়ে টু শব্দ করেন না, ঘাটাঘাটি করেন না। অন্যদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন যারা, নিজেদের দুর্নীতির কথা বেমালুম চেপে যাবেন এটাই হয়তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

দেখা যাচ্ছে যে কোনো কাজের জন্যই কিছু পূর্বশর্ত লাগে শুধু সম্পাদক হতে লাগে না। এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে না পারলে সাংবাদিকতায় এখন যে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে অদূর ভবিষ্যতে এই পেশার মান-সম্মান যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটিও আর থাকবে না। দেশের সংবাদমাধ্যমের এই অবস্থা থেকে উত্তরণে পেশাদার সাংবাদিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কোনো সরকারই স্বেচ্ছায় কখনোই অমন নীতিমালা করবে না যাতে অপেশাদাররা সম্পাদক হতে না পারেন। তাহলে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন সহজে করা যাবে না। আর প্রকাশকরাও ওই পদটি ছাড়তে চাইবেন না কারণ তাতে তাদের ব্যবসায়িক এজেন্ডাও বাস্তবায়নও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সাংবাদিকতা পেশার স্বার্থেই শিক্ষিত সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সম্পাদক

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর